মহাভারত থেকে কিছু দার্শণিক জীবনদর্শন মূলকতথ্য ও ব্যাখা সনাতন ভাবনা ও সংস্কৃতি

পুঁথি ঘেঁটে যা জানা যায়, সে সময়কার জনসংখ্যার আশি শতাংশ পুরুষ মহাভারতের ১৮ দিনের যুদ্ধে প্রাণ
যুদ্ধ শেষে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের সেই জায়গায় গমন করেন যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল।

কুরুক্ষেত্রের জমিতে দাঁড়িয়ে উনি ভাবতে থাকেন, সত্যিই কি সেই জায়গার মাটি যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে,মহাপ্রতাপশালী পান্ডব এবং কৌরবদের রক্তে শুষে নিয়েছে। এই চিন্তা যখন ওনার মস্তিষ্কে বিরাজ করিছে, এক কম্পিত কন্ঠ, বৃদ্ধের কোমল ধ্বনি তাঁর কানে বেজে ওঠে। তিনি শুনতে পান,

"তুমি কখনোই সত্য জানতে পারবে না বৎস..!!"

ঘুরে দাঁড়াতে সঞ্জয় গেরুয়া বস্ত্রধারী এক বৃদ্ধকে ধুলোর স্তম্ভ থেকে উঠে আসতে দেখেন।

-আমি জানি বৎস, তুমি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিষয় জানতে চাও কিন্তু ততক্ষণ তা তোমার বোধগম্য হইবে না, যতক্ষণ না তুমি বাস্তবে যুদ্ধটা কি বস্তু, সেটা বুঝিবে।

মৃদু হেসে বৃদ্ধ বলেন।

-তার মানে..?

-মহাভারত একটি দৃষ্টান্ত, একটি মহাকাব্য, হয়ত বাস্তব, হয়ত বা দর্শন।

মৃদু-মন্দ হেসে বৃদ্ধ সঞ্জয়ের দিকে তাকান। তাঁর মনে আরও প্রশ্ন উদ্রেক করাই বোধহয় তাঁর লক্ষ।

-আপনি দয়া করে যদি বলেন ওই দর্শন বস্তুটি কি..??

সঞ্জয় অনুরোধ করেন।

নিশ্চয়, এই বলিয়া বৃদ্ধ আরম্ভ করেন,

-পঞ্চপান্ডব আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় বই কিছু না। দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধ্বনি।

আর কৌরবরা কি, তা কি জান তুমি..?? দৃষ্টি সরু করে বৃদ্ধ শুধান।

কৌরব আমাদের একশতদোষ যারা নিত্য, প্রতিমুহূর্ত আমাদের ওই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে আক্রমণ করছে। জান কখন..??

সঞ্জয় আবার মাথা নাড়েন।

-শ্রীকৃষ্ণ যখন তোমার রথের সারথি হন, তখন..!!

বৃদ্ধ ঝকঝকে হাসি হাসেন এবং সঞ্জয় এই অন্তর্নিহিত জ্ঞান প্রাপ্তিযোগে অবাক চোখে বৃদ্ধকে দেখেন।

-শ্রীকৃষ্ণ তোমার অন্তর ধ্বনি, তোমার আত্মা, তোমার পথপ্রদর্শনকারি আলোককস্তম্ভ এবং তুমি যদি তাঁর হাতে নিজেকে সমর্পিত করে দাও, তুমি চিন্তামুক্ত থাকবে জীবনে।

সঞ্জয় বোকার মত বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু শীঘ্রই আবার সামলে নিয়ে পরের প্রশ্ন করেন,

-তাহলে দ্রোণাচার্য, ভীষ্মপিতামহ কেন কৌরবের হয়ে লড়াই করলেন, যদি কৌরবরা দোষী হয়..??

ধীরে মাথা সঞ্চালন করে বৃদ্ধ বলেন,

-ইহার মানে, যখন তুমি বড় হও, তোমার ধারণা বয়স্ক মানুষদের প্রতি বদল হতে থাকে। ছেলেবেলায় যে বয়ঃজ্যেষ্টদের মনে হত তারা সঠিক, বড় হয়ে বুঝতে পার, ততটা ঠিক নন তারা। তাদেরও দোষ আছে। এবং একটা দিন আসে যখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের সংগ তোমার জন্যে ভাল কি মন্দ। তারপর এটাও হয়ত তুমি উপলব্ধি কর একটা সময়, তাদের সাথে লড়াই করাই তোমার জন্যে মংগলের। বেড়ে ওঠার ইহাই সবচাইতে কঠিন পক্ষ এবং সেইজন্যেই গীতার সারমর্ম জানা দরকার।

বাকরূদ্ধ হইয়া সঞ্জয় মাটির ওপর হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়েন। ইহার কারণ এই নয় যে এই বাণী ক্লান্তিজনিত তাঁর কাছে বরং এই দর্শনের মাত্রাধিকতায় তিনি আবিভূত হইয়া পড়েন।

-তাহলে কর্ণকে কি বলবেন..??

-আহ্, তুমি সর্বোত্তম প্রশ্ন সবার শেষে করেছ। কর্ণ তোমার ইন্দ্রিয়গণের ভ্রাতা। সে বাসনা। সে তোমারই এক অংশ কিন্তু সে সংগ দেয় দোষের। যদিও সে দোষীর সংগ দিয়ে মনে মনে পীড়া অনুভব করে কিন্তু নিজেকে ঠিক সাবস্ত করার জন্যে নানান যুক্তি দেয়, ঠিক যেমন তোমার বাসনা সর্বক্ষণ তোমায় যুক্তি যুগিয়ে চলে। তোমার বাসনা তোমায় মিথ্যে যুক্তি দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করেনা কি সর্বদা..??

সঞ্জয় নিঃশব্দে মাথা নাড়ান।

এক দৃষ্টিতে তিনি কুরুভুমির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে তাঁর লক্ষ-কোটি চিন্তা তোলপাড় করে। প্রতিটি কথা গুছিয়ে তিনি সামঞ্জস্য তৈরি করার চেষ্টা করেন। খানিক বাদে যখন তিনি মাথা তোলেন, বৃদ্ধ তখন সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন। ধুলোর স্তম্ভে আবার মিলিয়ে গেছেন।

পেছনে ফেলে রেখে, এক চিলতে জীবনদর্শন..!!
হারিয়েছিলেন।
Share on Google Plus

About Unknown

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment