শ্রীশ্রী করুনাময়ী মাতা ঠাকুরানীর মঠের ইতিহাস সনাতন ভাবনা ও সংস্কৃতি

 ভারতে মুঘল রাজবংন্সের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্তরসুরী রুপে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন হুমায়ুন পুত্র আকবর। তাঁর লখ্য ছিল এক বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন। সম্রাটের এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্রাট আকবর এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুবরাজ সেলিমকে বাংলাদেশ অভিজানে পাঠান। কিন্তু যশোরের জমিদার প্রতাপাদিত্য (বারভুঁইয়া) মাঁ যশোরেশ্বরীর আশির্ব্বাদী ফুল অবলম্বন করে মুঘল আক্রমণের মোকাবিলা করেন। সেই যুদ্ধে যুবরাজ সেলিম পরাজিত হলেন। এর পর সম্রাট আকবর অম্বররাজ সেনাপতি মানসিংহকে দ্বিতীয় বারের জন্য বাংলাদেশ আক্রমনে পাঠান। কৌশলী সেনাপতি মানসিংহ তাঁর চর মারফৎ প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, প্রতাপাদিত্যের শক্তি ও পরাক্রমের উৎস হলেন শ্রীশ্রী মাতা যশোরেশ্বরী।

তাই মানসিংহ এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় মন্দির থেকে যশোরেশ্বরী মাতার বিগ্রহকে সরিয়ে নিজ শিবিরে নিয়ে আসেন। এই সংবাদে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে প্রতাপাদিত্য মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামানন্দগিরি গোস্বামীকে যৎপরনাস্তি তিরস্কিৃত করলেন। শোকে বিহ্বল পরম ধার্মিক ব্রাহ্মণ দুঃখে উন্মাদ হয়ে যশোর ত্যাগ করেন। অম্বররাজ ঠিক সেই মুহুর্তে মোঘল বাহিনী নিয়ে প্রতাপাদিত্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে বাংলাদেশ দখল করলেন।

বাংলাদেশ অভিযান সফল হয়ার পর অম্বররাজ মাতৃ বিগ্রহকে সন্মানের সাথে অম্বর প্রাসাদে অধিষ্ঠান করালেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেই 'যশোরেশ্বরী' মাতৃবিগ্রহ রাজস্থানের অম্বর ফোটে আজও অবস্থান করছেন।

অম্বরফোটে মাতৃবিগ্রহ অধিষ্ঠানের পরেই মহারাজ মানসিংহ দেবীর কাছে স্বপ্নাদেশ পান যে - তিনি যেন, দেবীর প্রধান পুরোহিত পরম ভক্ত ব্রাহ্মণ রামানন্দগিরি গোস্বামীকে দিয়ে দেবীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তি তৈরী ও প্রতিষ্ঠান করে আসেন। দেবীর আদেশে মানসিংহ বাংলাদেশে এসে রামানন্দগিরির খোঁজ করে যমুণা শাখা সূক্ষাবতী (বর্তমান নাম সুঁটির খাল -- জবরদখল হয়ে এ' নাম হয়েছে) নদীর তীরবর্তী মাতার বর্ত্তমান মন্দিরের নিকট সেই ব্রাহ্মণের দেখা পান এবং যশোরেশ্বরীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তি তৈরী ও প্রতিষ্ঠান করে আসেন। প্রাচীন সেই পুরোহিতের নাম ও নদীর তীরবর্তী স্থান অনুযায়ী ঐ স্থানের নাম হয় ‘রামডাঙ্গা’। পরবর্ত্তী কালে বাংলা ভাষার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সেটি ‘আমডাঙ্গা’ নামে এবং মন্দিরটি ‘আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠ’ নামে পরিচিত।

এর পর প্রায় দুশো বছর অতিবাহিত করার পর ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের উৎখাত করার জন্য সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন তখন নবাবের সেই বাহিনীতে নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও ছিলেন। বর্ত্তমান মন্দিরের নিকট নবাবের শিবির হয়েছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই শিবিরের পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাতৃমূর্ত্তির জীর্ণ দশা দেখতে পান। সেই সময়েই তিনি মাতৃমূর্ত্তির সামনে বসে প্রার্থনা করেন -- যদি মাঁ তার মনোকাম্না পূর্ণ করেন, তা হলে তিনি মাতার মন্দিরের তথা পূজার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহন করবেন।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হবার পর বাংলার সিংহাসনে বসলেন মীরজাফর, তার পর তাকে পরাজিত করে তার জামতা মীরকাশিম সিংহাসনে বসেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে নবাব মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গেরে বন্দী করে প্রানদন্ডের আদেশ দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই বিপদে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠের মোহান্ত পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে করুনাময়ী মাতৃদেবীর আরাধনা করে দৈব শক্তির প্রভাবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বিপদ-মুক্ত করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মাতৃদেবীর এই অপার করুণায় খুশী হয়ে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠ সংস্কারে ব্রতী হন। শোনা যায় তাঁরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মঠের বর্ত্তমান দ্বিতল মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সেই সময় থেকে এই ‘মঠ’ শুধু বাংলাদেশ নয় সারা ভারতেও পরিচিতি লাভ করে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত করুনাময়ীর জাগ্রত রুপ দর্শন করতে আসা শুরু করেন। মা করুনাময়ীর অপার করুণায় ভক্তগণের মনোবাঞ্ছা পূ্রণ সহ বিবিধ রোগ, জ্বালা নিবারণেরর এক মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় এই ‘মঠ’।

মঠের প্রথম সেবাইত রামানন্দগিরির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্ত্তী কালের মোহান্তগণ মঠকে ধর্মীয় তথা আধ্যাতিক দিক থেকে এক উজ্জ্বল অবস্থায় আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে গিরি অধ্যায়ের শেষ মোহান্ত রতন গিরি মোহান্ত পদে উত্তরাধিকার নিয়ে কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। উচ্চ আদালতের সম্মতি অনুযায়ী মহামান্য হাওড়া জেলা জজ করুনাময়ী মঠের পর্যবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ তথা প্রশাসক রুপে দায়িত্ব পান। মঠ পরিচালন সংক্রান্ত বিসয়ে পরিচালন কমিটির প্রথম সম্পাদক হন প্রকাশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়। ইতিপূর্বে করুনাময়ী মঠ তারকেশ্বর মন্ডলীর অর্ন্তভুক্ত হয়েছিল। মোহান্ত পদে গিরি অধ্যায়ের সমাপ্তির পর আশ্রম অধ্যায়ের সূচনা হয়। আমডাঙ্গা মঠের আশ্রম পর্বের প্রথম মোহান্ত হয়ে আসেন দন্ডীস্বামী অচ্যুৎ আশ্রম। পরবর্তী কালে একে একে মোহান্ত পদে অভিষিক্ত হন দন্ডীস্বামী নৃ্সিংহ আশ্রম ও দন্ডীস্বামী বিশ্বেশ্বর আশ্রম, তাঁর আমলে মঠের পূজা ভোগ ও বলিদান সংক্রান্ত বিষয়ে মঠ কমিটির সহিত তাঁর মতবিরোধ চরমে ওঠে। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৬২ সনে মঠে এক ধর্মীয় বিচার সভা আহূত হয়। এই ধর্মীয় বিচার সভায় কোন সুষ্ঠ নিষ্পত্তি না হওয়ায় অভিমানে দন্ডীস্বামী বিশ্বেশ্বর আশ্রম মঠ পরিত্যাগ করে কাশীবাসী হন। তৎপরবর্ত্তি কালে এক টানা প্রায় ২০ বৎসর মঠ পরিচালন ব্যাবস্থা কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকে। মঠ পরিচালন সমিতির দ্বিতীয় সম্পাদক নিযুক্ত হন শ্রীযুক্ত সুধাংশু বন্দোপাধ্যায় মহাশয়। তাঁর আমলে মঠের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে এলাকার জনসাধারণ মহামান্য হাওড়া জেলা জজের দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি তদন্ত করে কমিটি বাতিল করে দেন।

১৯৮৩ সালের মে মাসে মহামান্য হাওড়া জেলা জজ নূতুন পরিচালন সমিতি গঠন করেন এবং এই নবগঠিত পরিচালক সমিতির সম্পাদক রুপে মাননীয় শ্রীযুক্ত শঙ্কর ঘোষ মহাশয়কে মনোনীত করেন। ইতিমধ্যে ১৯৮৪ সালে দীর্ঘ ২২ বছর বাদে মঠে মোহান্ত রুপে তারকেশ্বর মন্ডলীর প্রতিনিধি হয়ে আসেন দন্ডীস্বামী শিবাশ্রম মহারাজ। তাঁর সভাপতিত্বে এবং শ্রীযুক্ত শঙ্কর ঘোষ মহাশয়ের সহৃদতায় মঠে এক স্বর্গীয় অনুভূতি বিরাজ করতে থাকে।

বর্ত্তমান মন্দির সংলগ্ন মাঁয়ের উল্লিখিত ফাঁকা জমিতে মাঁয়ের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে ২৫ শে ও ২৬ শে ডিসেম্বর বৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মঠের বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘রত্নবেদী’। ভারতের মধ্যে একমাত্র শ্রীক্ষেত্র ছাড়া আর কোন তীর্থক্ষেত্রে এই রত্নবেদী নেই। রত্নবেদীর মহাত্ম হল ১০৮ টি নারায়ণ শীলার উপর প্রতিষ্ঠিত এই আসন। শোনা যায় এই রত্নবেদীর আকর্ষনেই মহাসাধক রামপ্রসাদ ও পরমহংস ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের আগমন ঘটেছিল এই মঠে। মঠের দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল ‘পঞ্চমুন্ডী আসন’। তন্ত্র সাধকেরা এই আসনে বসে তন্ত্র সাধন করেন। উল্লেখ্য, ব্রহ্মপরায়ন উপাধিকারী সেবাইত নারায়ণ গিরি এই আসনে বসেই সাধনার দ্বারা দৈববলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে রক্ষা করেন।

মঠের তৃতীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল ‘মনসা বেদী (বাস্তুতলা)’। নিষ্ঠাভরে এই বেদীতে দুধ কলা সহযোগে পূজা দিলে সর্পদংশন ভয় দূ্র হয়। এছারা ব্রজমোহন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমময় যুগল মূর্ত্তি মন্দিরের আকর্ষণ বৃদ্ধি করছে। সর্বোপরি শ্রীশ্রী করুনাময়ী মাতা ঠাকুরাণীর কষ্ঠিপাথরের নির্মিত মূর্ত্তিটি মাতার নামকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল করে রেখেছে। মাতার সম্মুখের চন্দন কাঠের সূক্ষ কারুকার্য্য শোভিত দরজাটিও দীর্ঘ ৪৫০ বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষ হয়ে আজও অক্ষত অবস্থায় বর্ত্তমান আছে।

জয় কালী ......জয় কালী
Share on Google Plus

About Unknown

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment