বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির: অক্ষরধাম

 পরিপূর্ণ ভারতীয় সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি অপূর্ব অক্ষরধাম মন্দিরটি ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত। এই মন্দিরকে স্থানীয়রা দিল্লি অক্ষরধাম বা স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির নামেও বলে থাকেন। বোচাসন্ন্যাসী শ্রী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থার গুরু প্রমুখ স্বামী মহারাজের অনুপ্রেরণায় এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়।

দিল্লি বেড়াতে গেলে কোনও পর্যটকই এই মন্দির না দেখে আসেন না। বাস্তুশাস্ত্র ও পঞ্চতন্ত্র শাস্ত্রের সমস্ত রীতি মেনে গোটা মন্দিরটি গঠিত হয়েছে। বহু বছর ধরে কাজ চলার পর অবশেষে ২০০৫ সালে মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়। দর্শক, ভক্ত ও পর্যটকদের জন্যও খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত মন্দিরের একাংশে দামী পাথর দিয়ে স্বামী নারায়ণ ও ভারতের ইতিহাস বর্ণিত রয়েছে।

মন্দিরের বর্ণনা

মন্দিরের মূল অংশটি প্রায় ১৪১ ফুট উচু, ৩১৬ ফুট চওড়া, ৩৫৬ ফুট লম্বা। মন্দিরের মধ্যে রয়েছে ২৩৪ পিলার, ৯টি বিশাল গম্বুজ ও ২০,০০০ মূর্তি ও হিন্দু দেব-দেবী, সাধু-আচার্যদের স্থাপত্য। গোটা মন্দিরটি রাজস্তানের গোলাপী বেলেপাথর ও ইটালিয়ান কারারা মার্বেল দিয়ে তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, মন্দির তৈরিতে স্টিল বা কংক্রিট ব্যবহার হয়নি। হিন্দু সংস্কৃতি ও ভারতের ইতিহাসকে মিলিয়ে মন্দিরের বহু অংশে হাতির স্থাপত্য বানানো হয়েছে। প্রতিটি হাতির স্থাপত্যের ওজন প্রায় ৩০০০ টন।

মন্দিরের মধ্যেই রয়েছে প্রদর্শনী হল, থিয়েটার, মিউজিকাল ফাউন্টেন, গার্ডেন অফ ইন্ডিয়া। এছাড়া রয়েছে পদ্ম ফুলের ধাঁচে বিশালাকার সুসদৃশ্য বাগান, যা যোগী হৃদয় কোমল নামে পরিচিত। এছাড়া নীলকান্ত অভিষেক, নারায়ণ সরোবর, প্রেমাতি ফুড কোর্ট, আর্শ সেন্টার প্রভৃতি এই মন্দিরেরই অংশ।

কীভাবে মন্দির তৈরি হল

১৯৬৮ সালে বিএপিএস সংঘের প্রধান স্বামী নারায়ণ সন্ত যোগী মহারাজ 'অক্ষরধাম' তৈরির প্রথম ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, যমুনা নদীর তীরে এই মন্দির তৈরি হবে। এবং সংঘের দু'তিনজন সদস্য দিল্লিতে থাকবেন মন্দির তৈরির তত্ত্বাবধানের জন্য। পরিকল্পনা যখন সবেমাত্র বাস্তবায়িত হতে চলেছে ঠিক তখনই ১৯৭১-য় যোগী মহারাজের দেহাবসান হয়।

এরপর ১৯৮২-তে বিএপিএস সংঘের পরবর্তী প্রধান প্রমুখ স্বামী মহারাজ যোগী মহারাজের স্বপ্নপূরণে ব্রতী হন। সেই মতো তিনি দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র কাছে মন্দির তৈরির জন্য জমি চান। ডিডিএ-র পক্ষ থেকে গাজিয়াবাদ, গুরগাঁও এবং ফরিদাবাদে মন্দির স্থাপনের জন্য জমি দেওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু গুরুজির ইচ্ছানুসারে দিল্লিতে যমুনা-র তীরে মন্দির বানানোর সঙ্কল্পে অটুট থাকেন প্রমুখ স্বামী মহারাজ। অবশেষে ২০০০-এর এপ্রিলে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ৬০ একর ও উত্তরপ্রদেশ সরকার ৩০ হাজার একর জমি অনুদান দেন। মন্দিরের জন্য জমি মিলতেই প্রথমে বাস্তুপুজো করেন স্বামীজি। ওই বছরেরই নভেম্বর মাস থেকে মন্দিরের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। কাজ শেষ হয় ২০০৫ নাগাদ। সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ঘটে ২০০৫-এর নভেম্বরে। মন্দিরটি বানাতে কম-বেশি পাঁচ বছর সময় লেগেছিল।

সংঘের আট জন সাধুর উপর মন্দির তৈরির দেখ-ভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কারণ, তাঁরা গুজরাটের গান্ধিনগরে অবস্থিত 'অক্ষরধাম'-এর আরেকটি শাখা তৈরির সময় উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং, মন্দির তৈরির অভিজ্ঞতা তাঁদের আগেই ছিল। এছাড়াও, প্রমুখ স্বামী মহারাজ নিজে বিষয়টি নিয়ে একাধিক স্থপতির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৭-১৯৯৮ সাল থেকেই মন্দিরের জন্য পাথর খোদাইয়ের কাজ শুরুর জল্পনা সদস্যদের মনে দেখা দিলেও স্বামী মহারাজ জানান, জমি পাওয়ার পরই কাজ শুরু হবে।

২০০১ সালে মন্দিরের প্রথম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। আট জন সাধু 'পঞ্চরত্র শাস্ত্র' অনুসারে মন্দির তৈরির অনুরোধ জানান স্থপতিদের। সেই অনুসারে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর ভারতীয় স্থাপত্য রীতি মেনে 'অক্ষরধাম' তৈরি হয়। তাই এই মন্দিরের গায়ে আঙ্কোর ভাট, যোধপুর, পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির, কোনারক, ওডিশার ভুবনেশ্বর মন্দির সহ দক্ষিণ ভারতের বহু মন্দির গাত্রের কারুকাজ দেখা যায়।

সাত হাজার ভাস্কর এবং তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবকের অক্লান্ত পরিশ্রমে 'অক্ষরধাম' তৈরি। এর জন্য প্রায় ছয় হাজার টন গোলাপি পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। ভাস্করদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন স্থানীয় কৃষক এবং দেড় হাজার উপজাতি মহিলা। প্রথমে কিছু পাথর মেশিন দিয়ে কাটা হলেও খোদাইয়ের বাকি সূক্ষ্ম কাজ হাতেই করা হয়। রোজ রাতে মন্দির তৈরি করার কাজ করতে ১০০টি লরি করে চার হাজার শ্রমিক আসতেন।

অবশেষে এল সেই স্বপ্নপূরণের দিন। ২০০৫-এর ৬ নভেম্বর প্রমুখ স্বামী মহারাজ ও তত্‍কালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম-এর উপস্থিতিতে 'অক্ষরধাম'-এর উদ্বোধন হয়। উপস্থিত ছিলেন তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ভারতীয় সংসদের বিরোধী নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি সহ প্রায় ২৫ হাজার আমন্ত্রিত। রাষ্ট্রপতি কালাম 'অক্ষরধাম' সম্বন্ধে দু'চার কথা বলেন। প্রমুখ স্বামী মহারাজ জানান, প্রাচীন ও আধুনিকতার মেলবন্ধন এই মন্দির। প্রকৃতপক্ষে এটি জ্ঞান, ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার পীঠস্থান।

২০১০-এর ১৩ জুলাই নতুন করে মন্দিরে গর্ভগৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রমুখ স্বামী মহারাজ উদ্বোধন করেন। এখানে সিংহাসনে উপর স্বামী নারায়ণের মূর্তি বসানো আছে। এর চারপাশে সোনার সূক্ষ্ম কাজ। ২০১০-এ দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস-এর সময়ে থেকেই 'অক্ষরধাম' জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। প্রায় শতাধিক ক্রীড়াবিদ সহ হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসেন 'অক্ষরধাম'। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর সংঘের মহিলা সদস্যরা এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যার মাধ্যমে মন্দির, মসজিদ, চার্চের মাধ্যমে সেবা বা সামাজিক উপকারিতা-র কথা প্রচার করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে হিন্দু-আমেরিকান সেবা চ্যারিটি-র কর্ণধার অঞ্জু ভার্গব ও চ্যারিটির সভাপতি রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।

শুধু স্থাপত্যের জন্য নয়, সমস্ত হিন্দু মন্দিরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো হিন্দু মন্দির হিসেবে 'অক্ষরধাম' গিনেস ওয়র্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নিয়েছে। ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সরকারি বিশ্ব-রেকর্ড নির্ণায়ক মাইকেল উইটি আমেদাবাদে এসে প্রমুখ স্বামী মহারাজের হাতে শংসাপত্র তুলে দিয়ে যান। শংসাপত্রে 'অক্ষরধাম' সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য লেখা রয়েছে। মাইকেল উইটি জানিয়েছিলেন, মন্দিরের স্থাপত্যের তথ্য জানতে সংস্থার প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। এতে একাধারে সনাতনী ও আধুনিক হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতি স্থান পেয়েছে। তাই 'অক্ষরধাম' এই বিশেষ পুরস্কারের যোগ্য।
Share on Google Plus

About Unknown

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment